মিথ্যা সংবাদের বিরুদ্ধে সংগীতশিল্পী সাজেদ ফাতেমীর প্রতিবাদ

লালমনিরহাটে একটি মানববন্ধন থেকে আমার আব্বাকে রাজাকার ও আমার পরিবারের বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবির তকমা দেয়ার অপচেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। গত ১৯ সেপ্টেম্বর শনিবার ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ লালমনিরহাট জেলা শাখা ওই মানববন্ধন আয়োজন করে।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত ‘শত গানে বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামে বইয়ে স্থান পাওয়া আমার লেখা গান দুটি প্রত্যাহারের দাবিতে ওই মানববন্ধন হয়। বক্তারা এ সময় আমার বাবাকে রাজাকার এবং আমাকে ও আমার পুরো পরিবারের সঙ্গে জামাত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে আমার গান দুটি বাদ দিয়ে বইটি নতুন করে প্রকাশের দাবি জানান। মানববন্ধনকারীরা এ সময় সাংবাদিক ও উপস্থিত নেতা-কর্মীদের কাছে অর্ধসত্য, অসত্য, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ভুল তথ্যে ভরা একটি লিফলেট বিতরণ করেন, যা আমার পরিবারের দীর্ঘদিনের সুনাম ক্ষুণ্ণ করেছে।
আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলছি – আমার আব্বা রাজাকার ছিলেন না। কখনো না, কখনো না, কখনো না। আব্বা ছিলেন চিকিৎসক। সে সময় তিনি বহু যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে গোপনে চিকিৎসা দিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এরই মধ্যে তার বড় দুই ছেলে মুক্তিযুদ্ধে চলে যান। তার বড় দুই ছেলে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টিকে ‘অপরাধ’ বিবেচনা করে একদিন তাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতন করে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারেরা।
মানববন্ধনকারীরা আমার আব্বার নামের সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে কিছুটা মিল থাকা অন্য একটি স্থানের আরেক ব্যক্তিকে গুলিয়ে ফেলে আব্বাকে রাজাকার প্রমাণ করার অপচেষ্টা চালিয়েছেন। এটি করতে গিয়ে তারা একগাদা মিথ্যা তথ্য ও কাল্পনিক গল্প সাজিয়েছেন।
আমার পরিবারের সঙ্গে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ শতভাগ মিথ্যা। ১১ ভাই–বোনের মধ্যে মাত্র একজন জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। অসুস্থতা ও আর্থিক সংকটের কারণে গত প্রায় পাঁচ বছর থেকে দলীয় সব কর্মকাণ্ড থেকে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন।
আমার বড় ও মেজো ভাই ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর লালমনিরহাটে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত। মেজো ভাই গত বছর মৃত্যুবরণ করেছেন। লালমনিরহাট শহরের মিশনমোড়ে মেজো ভাইয়ের মালিকানাধীন পলাশী হোটেল জেলা আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের আড্ডাস্থল। আমার আর কোনো ভাই কোনোদিন কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, ছাত্রদল বা ছাত্রশিবির করা দূরের কথা। এতো বড় একটি পরিবারের মাত্র একজন সদস্য একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল করার বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও হাস্যকরভাবে সামনে এনে পুরো পরিবারকে জামায়াত-শিবির তকমা দেয়ার এই অপচেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
মানববন্ধনকারীরা আমাদের সব সত্য তথ্য জেনেও তা এড়িয়ে গিয়ে সম্পূর্ণ মিথ্যাচার করেছেন। অবশ্য তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গান দুটি বাতিল করার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে ইতিমধ্যে লালমনিহাটের জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ।
- মানববন্ধনকারীদের সব অভিযোগ ও সেগুলোর বিস্তারিত জবাব সংযুক্ত করা হলোঃ
আমার ও আমার পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগের সবিনয় জবাব
আসসালামুয়ালাইকুম।
আমি সাজেদ ফাতেমী। আমার ও আমার পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগের সবিনয় জবাব সবার জ্ঞাতার্থে জানালাম।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে সম্প্রতি ‘শত গানে বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি বইয়ে আমার লেখা ‘তুমিই পিতা’ ও ‘মহামানব’ শিরোনামে দুটি গান স্থান পেয়েছে। বইটি থেকে সেই গান দুটো প্রত্যাহারের দাবিতে ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ লালমনিরহাট জেলা শাখা গত ১৯ সেপ্টেম্বর শনিবার দুপুরে আমার নিজের জেলা শহর লালমনিরহাটে মানববন্ধন করে। মানববন্ধন থেকে আমার বাবাকে রাজাকার এবং আমাকে ও আমার পরিবারের সঙ্গে জামাত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে ওই গান দুটি বাদ দিয়ে বইটি নতুন করে প্রকাশের দাবি জানানো হয়। মানববন্ধন চলাকালে সাংবাদিক ও উপস্থিত নেতা-কর্মীদের কাছে অর্ধসত্য, অসত্য, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ভুল তথ্যে ভরা একটি লিফলেট বিতরণ করা হয়। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলছি –
- আমার আব্বা রাজাকার ছিলেন না। কখনো না, কখনো না, কখনো না।
- আমার পরিবারের সঙ্গে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ শতভাগ মিথ্যা। ১১ ভাই–বোনের মধ্যে মাত্র একজন জামায়াতের রাজনীতি করেন মানে পুরো পরিবারকে সেই দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।
আমরা যে কেউ যে কারও বিরুদ্ধে যেকোনো অভিযোগ যেকোনো সময় তুলতে পারি। তবে কোনো ব্যক্তি বা তার পরিবারের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ জনসমক্ষে বা গণমাধ্যমে প্রকাশ করার আগে তার সত্যতা অবশ্যই যাচাই করে নিতে হয়। তা না করলে সেই অভিযুক্ত ব্যক্তি বা তার পরিবারের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। আমার অভিযোগের উদ্দেশ্য যদি হয় সেই ব্যক্তি বা তার পরিবারকে অপমানিত ও হেয়প্রতিপন্ন করা কিংবা ক্ষতিসাধন করা তাহলে তা ভিন্ন বিষয়। আর আমার উদ্দেশ্য যদি হয় প্রকৃত সত্য জানতে চাওয়া, তাহলে অভিযোগকারী ব্যক্তি বা সংগঠনের পক্ষ থেকে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা পরিবারের কাছে তা সরাসরি জানতে চাওয়াটাই সর্বোৎকৃষ্ট পথ। আমার ও আমার পরিবারের দুর্ভাগ্য, আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনকারীদের কেউই এ পথে হাঁটেননি। তারা হেঁটেছেন এমন এক পথে, যে পথ প্রকৃত সত্য, প্রকৃত তথ্য ও সততা থেকে বহু দূরে। ওই বইটি থেকে আমার লেখা গান দুটি প্রত্যাহার যদি তাদের মূল উদ্দেশ্য হতো, তাহলে এতো কিছু করার প্রয়োজন হতো না। একটি ফোনই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু গান দুটি বাতিল যেহেতু মূল উদ্দেশ্য ছিল না, তাই তারা মশা মারতে কামান দাগালেন। কিছু ভুল ও কাল্পনিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আমার পুরো পরিবারের ওপর কালিমা লেপনের চেষ্টা করলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমি অনুভব করছি, ‘শত গানে বঙ্গবন্ধু’ বইয়ে আমার লেখা দুটি গান থাকা খুব বেশি জরুরি নয়। বরং আমি আমার প্রাণের শহর লালমনিরহাটকে অস্থিরতামুক্ত দেখতে চাই। এ দুটি গান লেখার মধ্য দিয়ে আমি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছি। আমি জানি বঙ্গবন্ধু একজন বিশ্বনেতা। তিনি সব ধর্ম-বর্ণ-চেতনা ও আদর্শধারণকারী মানুষের। এখন দেখছি, কিছু মানুষ তাঁকে সংকীর্ণ গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ করে ফেলতে চাইছেন। আমার জন্মভূমিতে বসবাসরত সেই মানুষগুলোর মতামতের প্রতিও আমার সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা আছে। সেই শ্রদ্ধাবোধ থেকে এবং তাদের সঙ্গে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক অটুট রাখার স্বার্থে আমি নিজেই ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০ এ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে গান দুটো প্রত্যাহারের কথা বলি। জবাবে তিনি এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানান।
// আমার মতো একজন ক্ষুদ্র সংগীতকর্মীর লেখা গান দুটো প্রত্যাহার করানোর মধ্য দিয়ে লালমনিরহাটের মানববন্ধনকারীরা নতুন প্রজন্মকে যে বার্তা দিলেন, তাতে প্রগতিশীলতার পথই রুদ্ধ হলো। মানববন্ধনকারীদের এতো তীব্র আন্দোলন এবং আমার ও আমার প্রতি তাদের এতো ঘৃণার প্রকাশ দেখে দেখে বারবার একটা কথাই মনে হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুকে তারা আর যাই হোক- কেবল আওয়ামী লীগের বৃত্তেই বন্দী রাখতে চান। প্রজন্ম আসবে একের পর এক। তারাও ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শ ধারণ করবেন। তখন তাদের মধ্যেও কাউকে হয়তো আমার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে, যা কোনো রাষ্ট্র কিংবা সরকারের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না।
মানববন্ধনকারীদের আনীত প্রধান ৪ অভিযোগ
১। আমার আব্বা ডাঃ সোলায়মান মিয়া কুখ্যাত রাজাকার
২। আমিসহ আমাদের পুরো পরিবার জামাত ও বিএনপির সমর্থক
৩। আমাদের পরিবার রেলওয়ের জমিতে বসবাস করে
৪। আমার আব্বা পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে।
- উপরোক্ত চারটি অভিযোগের সব কটিই মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
মানববন্ধনকারীদের অভিযোগগুলোর জবাব
প্রথম অভিযোগ ও জবাব- মানববন্ধনকারীরা দাবি করেছে, আমার আব্বা ডাঃ সোলায়মান মিয়া কুখ্যাত রাজাকার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের প্রায় ৪৯ বছর পর এই প্রথমবার কেউ আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ এনে আমার বাবাকে পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করার অপপ্রয়াস চালালো।
আব্বা সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরার আগে আমার দাদা শেখ ছমির উদ্দিন আহমেদের কথা কিছুটা বলা প্রয়োজন। তিনি ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট, ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্য ছিলেন মোট ৪২ বছর। ১৯৩৯ সালে লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার নামুড়ী মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি ছিলেন। পরে ওই মাদ্রাসা প্রথমে নামুড়ী জুনিয়র স্কুলে এবং ১৯৬৫ সালে নামুড়ী হাই স্কুলে রূপান্তরিত হয়। তখন পর্যন্ত তিনি সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। তারপর হাইস্কুলে রূপান্তর হলে তখন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত ওই স্কুলের সভাপতি ছিলেন আমার আব্বা ডাঃ মোঃ সোলায়মান মিয়া। আমার দাদা মারা গেছেন ১৯৯৯ সালে।
আমার আব্বা ডাঃ মোঃ সোলায়মান মিয়া ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর নামুড়ী হাইস্কুল মাঠে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। তার সভাপতিত্বে সেই সভায় আলহাজ করিম উদ্দিন আহমেদ (পরে// সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন) প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন। আব্বা ছিলেন চিকিৎসক। ১৯৫৫ সালে বগুড়ার ন্যাশনাল মেডিক্যাল স্কুল থেকে মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট পাস করেন। চিকিৎসক হিসেবে তিনি গোপনে বহু যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে চিকিৎসা দেন। এ সময় তিনি সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এরই মধ্যে তার বড় দুই ছেলে মুক্তিযুদ্ধে চলে যান। তার বড় দুই ছেলে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টিকে ‘অপরাধ’ বিবেচনা করে একদিন তাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে কবরে শুইয়ে দিয়ে নির্মম নির্যাতন করে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারেরা।
উল্লেখ্য, আমার আব্বা নামুড়ীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একজন বিশিষ্ট মানুষ ছিলেন। তার মগজ মজ্জা ও মননে ছিল নাটক, যাত্রাপালা, গান, আবৃত্তি।
লালমনিরহাটের মানববন্ধনকারীরা আমার আব্বার নামের সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে কিছুটা মিল থাকা আরেক ব্যক্তিকে গুলিয়ে ফেলে আব্বাকে রাজাকার প্রমাণ করার অপচেষ্টা চালিয়েছেন। এটি করতে গিয়ে তারা একগাদা মিথ্যা তথ্য ও কাল্পনিক গল্প সাজিয়েছেন। পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের হাতে নির্যাতিত ভগ্ন শরীর নিয়ে সেই দুর্যোগকালেও গ্রামের মানুষকে তিনি চিকিৎসা দিয়ে বেড়িয়েছেন। মানববন্ধনকারীরা নাম বিভ্রাটের বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে তাকে রাজাকারের তকমা দিয়ে আমাদের পুরো পরিবারকে হেয় করার চেষ্টা করেছেন। আব্বা ১৯৯০ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
আমার আম্মা মোছা. ফাতেমা বেগম মুক্তিযুদ্ধের সময় বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বড় দুই ছেলে যুদ্ধে গেছে। তাদের মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুদের নিয়মিত খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। স্বামী পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের হাতে নির্যাতিত হওয়ার বেদনা বুকে নিয়ে তিনি রাত-দিন মানুষের সেবা দিয়ে গেছেন। রত্নগর্ভা (গ্র্যান্ড আজাদ হোটেল প্রবর্তিত) ও বেগম রোকেয়া (রংপুরের রোকেয়া ফাউন্ডেশন প্রবর্তিত) পদকপ্রাপ্ত আমার আম্মা ছিলেন স্কুলশিক্ষিকা। ১৯৭২ সালে তিনি বড় ছেলের সঙ্গে এসএসসি পাস করলে আলহাজ করিম উদ্দিন আহমেদ তাকে শিক্ষকতার চাকরি দেন)। তিনি ২০০৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
দ্বিতীয় অভিযোগ ও জবাব -মানববন্ধনকারীরা আমিসহ আমাদের পুরো পরিবার জামাত ও বিএনপির সমর্থক বলে দাবি করেছে, যা শতভাগ মিথ্যা।
বাস্তবতা হলো – আমাদের ১১ ভাই-বোনের মধ্যে মাত্র ১ জন জামায়াতের রাজনীতিতে জড়িত। আমার বড় দুই ভাই সরাসরি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে এবং পরে প্রত্যক্ষভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত। বাকি ভাইদের কেউই কোনো রাজনীতিতে জড়িত নই। মানববন্ধনকারীরা এই আট ভাইয়ের বিষয়ে সার্বিক কোনো চিত্র তুলে ধরেননি। তারা এক ভাইয়ের জামাত-সংশ্লিষ্টতার কারণে এবং আরেক ভাইকে শিবিরের কাল্পনিক বানিয়ে আমাদের পুরো পরিবারকে জামাতের তকমা দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
আমার সবচেয়ে বড় মোঃ সাইফুল ইসলাম ফাতেমী (জুয়েল) একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ। ১৯৭৩ সালে লালমনিরহাট কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের মান্নান-শফিকুল-দবিয়ার প্যানেল থেকে সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের এসএএস কর্মকর্তা হিসেবে ২০১৫ সালে অবসরে যান। অবসর গ্রহণের পর তিনি সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত হন। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আদিতমারী-কালীগঞ্জ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জনাব নুরুজ্জামান আহমেদের বিভিন্ন নির্বাচনী জনসভায় বক্তব্য দেয়ার কথা সর্বজনবিদিত। তিনি আদিতমারী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রফিকুল আলমের নির্বাচনী জনসভায়ও বক্তব্য দেন।
মেজো ভাই মোঃ আসাদুল ইসলাম ফাতেমী (রুবেল) বগুড়া আজিজুল হক কলেজে পড়ার সময় ১৯৭৮/৭৯ সালে ছাত্রলীগের ভিপি এবং পরে বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। মুজিবনগর কর্মচারী হিসেবে কর্মরত থাকার সনদপত্র উপস্থাপন সাপেক্ষে ১৯৮৪ সালে খাদ্যবিভাগে ফুড ইন্সপেক্টর হিসেবে চাকরি পান তিনি। লিফলেটে আমার ভাইকে ৬৯ এর ছাত্রলীগ নেতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যা ভুল। অবসরপ্রাপ্ত উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা আসাদুল ইসলাম ফাতেমী রুবেল ২০১৯ সালের ৪ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন। তিনি লালমনিরহাটের নাট্যঅঙ্গনের একজন জনপ্রিয় মানুষ ছিলেন।
চমকপ্রদ তথ্য হলো, লালমনিরহাটের মিশনমোড়ে অবস্থিত পলাশী হোটেলের মালিক আমার এই মেজোভাই, যে হোটেলটি মানববন্ধনকারী ও আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনকারী আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের প্রধান আড্ডাস্থল। অল্প কিছুদিন আগে পর্যন্ত এখানে বসেই দলীয় আলোচনা ও সিদ্ধান্তগুলো নিতেন তারা।
এক ভাই মোঃ আলাউল ইসলাম ফাতেমী (পাভেল) ১৯৯৯ সালে লালমনিরহাট জেলা জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি আদিতমারীর পলাশী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান (২০১১-২০১৫)। তিনি কখনোই জেলা জামাতের আমীর ছিলেন না।
তিনি জামায়াতের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার বিষয়টি পরিবারের অন্য সদস্যরা মেনে নেয়নি। তবে তার বিরুদ্ধে মানববন্ধনকারীদের আনা দুর্নীতির অভিযোগগুলো সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা। কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া দূরের কথা, বিন্দুমাত্র সঞ্চয়ও তার নেই। আমাদের গ্রামের বাড়িতে উপার্জনের টুকটাক উৎস থেকে আসা সামান্য টাকা দিয়ে স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে জীবন যাপন করছেন। তিনি দীর্ঘদিন থেকে নামুড়ী গার্লস হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের সভাপতি। উত্তরবঙ্গ টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং পলাশী এতিমখানার প্রতিষ্ঠাতা। দলীয় সব কর্মকাণ্ড থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন শারীরিক অসুস্থতা ও আর্থিক সংকটের কারণে।
এক ভাই কর্নেল মোঃ নেয়ামুল ইসলাম ফাতেমী, বীর প্রতীক, বিজিবিএম (অব.) সেনাবাহিনীতে ৩৩ বছর সফলভাবে চাকরি শেষ করে স্বাভাবিক অবসরে গেছেন ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। তিনি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে অনেক সফল অপারেশন সম্পন্ন করেছেন। এর স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮৯ সালে ‘বীরপ্রতীক’ খেতাবপ্রাপ্ত হন। বিজিবিতে তার সাহসিকতার স্বাক্ষর রাখায় বিজিবির সর্বোচ্চ খেতাব বিজিএম এ ভূষিত হন।
এক ভাই এমদাদুল ইসলাম ফাতেমী (হিমেল), আরেক ভাই ওয়াজেদুল ইসলাম ফাতেমী (সোয়েল) ও অন্য ভাই জিকরুল ইসলাম ফাতেমী (নিকেল) আলাদা তিনটি কলেজের শিক্ষক। মানববন্ধনকারীরা আমার সোয়েল ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে- তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজের শিবিরের নেতা ও দুর্ধর্ষ ক্যাডার ছিলেন, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও কল্পনাপ্রসূত। লালমনিরহাট সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর তিনি ঢাকায় পড়াশোনা করেছেন। তিনি কখনোই রংপুরে পড়াশোনা করেননি।
আমি সাজেদুল ইসলাম ফাতেমী (ব্যাটেল)। সাংস্কৃতিক অঙ্গন ও গণমাধ্যমে আমি সাজেদ ফাতেমী নামে পরিচিত।
আমার গানের শুরু ১৯৮৪ সাল থেকে। তখন শিশু শিল্পী হিসেবে লালমনিরহাট ও আশপাশের জেলা শহরে আমার নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়ে। লালমনিরহাট সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর ১৯৯২-৯৩ শিক্ষাবর্ষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে অনার্সে ভর্তি হই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির এক সপ্তাহের মাথায় আমি জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটারের সঙ্গে জড়িত হই। সেইসঙ্গে নিয়মিত কনসার্টেও অংশ নিতে থাকি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মোট ১৭টি মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছি এবং ‘বাজাও পাঞ্চজন্য’ নামে যাত্রাপালা-নির্ভর একটি নাটকসহ চারটি নাটকের নির্দেশনা দিয়েছি। ১৯৯৬ সালে আমার নির্দেশনা দেয়া ‘বাজাও পাঞ্চজন্য’ নাটক এখনো মঞ্চায়ন করে জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার। ১৯৯৭-৯৮ সালজুড়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র শিবিরবিরোধী ও ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন সফল করে তুলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কর্মীরা ব্যাপক ভুমিকা পালন করে। সেই সাংস্কৃতিক কর্মীদের অগ্রভাগে ছিলাম আমি। অথচ মানববন্ধনকারীরা এবং স্থানীয় কিছু সাংবাদিক আমাকে কখনো ছাত্রদলের নেতা আবার কখনো ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলার অপচেষ্টা করেছেন- যা সম্পূর্ণ মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও কল্পনাপ্রসূত।
একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে ২২ বছরে ছয়টি দৈনিক পত্রিকায় চাকরি করেছি। ১৯৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে দৈনিক লালসবুজ পত্রিকায় চাকরি শুরুর মধ্য দিয়ে আমার সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয়। এরপর ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দৈনিক মাতৃভূমির জন্মলগ্নে এর ইন্টারন্যাশনাল ডেস্কের সাব-এডিটর হিসেবে কাজ করি। একই বছর ডিসেম্বরে দৈনিক যুগান্তরের জন্মলগ্নে কাজ শুরু করি। এই পত্রিকার ফিচার ও সম্পাদকীয় বিভাগে একই সঙ্গে কাজ করি। সেখান থেকে ২০০৪ সালের আগস্টে দৈনিক নয়াদিগন্তের জন্মলগ্নে যোগ দেই পত্রিকাটিতে। সেখান থেকে ২০০৯ সালের জুনে দৈনিক সমকালের ইন্টারন্যাশনাল ডেস্কের ইন-চার্জ হিসেবে যোগ দেই। সমকাল থেকে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে যোগ দেই প্রথম আলোতে। ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সেখানে কাজ করি। মানববন্ধকারীরা আমাকে জামাত সমর্থক হিসেবে প্রমাণের অপচেষ্টা থেকে শুধু নয়াদিগন্তে সাংবাদিকতা করার কথাটুকু উল্লেখ করেছেন।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি আমি পেশাদার শিল্পী হিসেবে ২০ বছর থেকে এবং পেশাদার গীতিকার, সুরকার ও উপস্থাপক হিসেবে গত ১৬ বছর থেকে কাজ করছি। বিনয়ের সঙ্গে বলছি, বাংলাদেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির গত ১৫ বছরের ইতিহাসে ব্যতিক্রমী কাজগুলোর একটি বড় অংশ আমার করা, যা লালমনিরহাটের মানুষ জানেন। হয়তো এটাও জানেন, সাজেদ ফাতেমীই লালমনিরহাট জেলার প্রথম শিল্পী, যার অডিও ক্যাসেট ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয়।
জিকরুল ইসলাম ফাতেমী (নিকেল) একটি কলেজে শিক্ষকতার পাশাপাশি লালমনিরহাটের ক্রিকেট অঙ্গনের একটি পরিচিত নাম। জাতীয় মানের খেলোয়াড় তৈরির উদ্দেশ্যে তিনি ২০০৮ সালে ‘লালমনিরহাট ক্রিকেট একাডেমী’ তৈরি করেন। সেই প্রতিষ্ঠান থেকে এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন নামী ক্রিকেটার পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে লালমনিরহাট স্টেডিয়ামে জাতীয় স্কুল ক্রিকেটের একটি ম্যাচে তার একাডেমীর ছাত্র মোস্তাফিজুর রহমান লিপু ৩২৫ রানের এক অনবদ্য স্কোর করে। এটি পুরো পৃথিবীর বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানের ইনিংস হিসেবে ক্রিক ইনফোতে জায়গা করে নিয়েছে। এ বছর (২০২০) বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব ১৯ দলের প্রাথমিক স্কোয়াডে জায়গা পাওয়া পেসবোলার মুশফিক হাসান তারই ছাত্র। জিকরুল ইসলাম ফাতেমী গত চার বছর ধরে লালমনিরহাট জেলা ক্রিকেট কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আমার সর্বশেষ অর্থাৎ নবম ভাই জিয়াউল ইসলাম ফাতেমী বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার (সেনাবাহিনীর মেজর সমমর্যাদার) থাকা অবস্থায় স্বেচ্ছা অবসরে গেছেন। তার শ্বশুর আমার পরিবারের কেউ নয়।
তৃতীয় অভিযোগ ও জবাব – আমাদের পরিবার জেলা শহরের মিশন স্কুলের সামনে রেলওয়ের জমিতে বসবাস করে বলে একটি মিথ্যা ও কাল্পনিক অভিযোগ করেছেন মানববন্ধনকারীরা। সত্যিটা হলো- আমরা কোনো আগন্তক নই। আমার পরিবারের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার উশৃঙ্খলতার রেকর্ড কোথাও নেই। আমাদের আদি বাড়ি লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলার পলাশী ইউনিয়নের মদনপুর (যুগিরমহল) গ্রামে। আমাদের পরিবার লালমনিরহাটের মিশনপাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা ১৯৬৬ সাল থেকে। তখন আমাদের কেনা ২৬ শতাংশ জমির ওপর বাড়ি ছিল। ১৯৭৪ সালে সেখান থেকে ১৪ শতাংশ বিক্রি করা হয়। অবশিষ্ট ১২ শতকের মধ্যে সাড়ে পাঁচ শতক জমির ওপর আমাদের বর্তমান বাড়িটির অবস্থান। বাকি সাড়ে ছয় শতক জমি তিন দিক থেকে বেদখল অবস্থায় আছে। আমাদের বাড়ির সামনের দিকের রাস্তা সংলগ্ন ৫০ ফুট বাই ১২ ফুট জমি রেলের কাছ থেকে বিধিমোতাবেক ইজারা নেয়া আছে। আমরা রেলের জমিতে বসবাস তো করছিই না, বরং আমাদের বেদখল থাকা জমির একটি অংশ আমাদেরই বাড়ির পূর্ব ও উত্তর দিকে অবস্থানরত প্রতিবেশিদের দখলে আছে।
চতুর্থ অভিযোগ ও জবাব– আমার আব্বা পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে বলে মানববন্ধনকারীদের দাবিটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বরং ঘটেছে উল্টোটা। আব্বার জনপ্রিয়তা ও তার বড় দুই ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়াকে ‘অপরাধ’ বিবেচনা করে পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা আব্বাকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতনের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। ওই ঘটনার অল্পদিনের মধ্যে আমাদের এলাকার ৪৮ জন ব্যক্তিকে মালগাড়িতে তুলে লালমনিরহাটে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। এ খবর পেয়ে আব্বা তার জনপ্রিয়তার ওপর বিশ্বাস রেখে কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে লালমনিরহাটে যান। তিনি সেখানে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে দেনদরবার করে ওই ব্যক্তিদের জীবিত ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। এই মানুষগুলোর বংশধরেরা এখনো বেঁচে আছেন।
বড় দুই ভাইয়ের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া
১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল আমার সবচেয়ে বড় ভাই মোঃ সাইফুল ইসলাম ফাতেমী জুয়েল স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে গিয়ে যুদ্ধে শামিল হন। এসএসসি পরীক্ষার্থী আমার এই বড় ভাই আদিতমারীর কমলাবাড়ী ইউনিয়নের চন্দনপাট ময়নাচরা এলাকায় শামসুদ্দিন মিয়া ও হোসেন দেওয়ান মিয়ার বাড়িতে অবস্থিত ‘সি’ কোম্পানিতে যোগ দেন। সেই কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন তাজির আলী (পরে তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজের অধ্যাপক হয়েছিলেন)। তাজির আলীর তত্ত্বাবধানে ৮টি প্লাটুন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। তার সঙ্গে ছিলেন ইমান আলী ও গোলাম মোস্তফা। সাইফুল ইসলাম ফাতেমী ওই কোম্পানির সব স্টোরের দায়িত্ব পালন করেন। তখন তাকে সহযোগিতা করেছেন চলবলা ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিজুর পিতা মৃত আব্দুস সামাদ মেম্বার। একটি প্লাটুনের দায়িত্তে ছিলেন লালমনিরহাটের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম মন্টু। মহসীনুল আলম টুলু এবং বর্তমান সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর ছোট ভাই অধ্যক্ষ রশিদুজ্জামান মুজিববাহিনীর দায়িত্তে থেকে এই প্লাটুনগুলো নিয়মিত পরিদর্শন করতেন। রশিদুজ্জামানের সঙ্গে আমার বড় ভাইয়ের মাঝেমধ্যেই কথা হতো। যুদ্ধ চলাকালে লালমনিরহাট জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার মেজবাহ উদ্দিনের সঙ্গে বিভিন্ন সময় আমার ভাইয়ের যোগাযোগ ও সাক্ষাৎ হতো।
এদিকে আমার মেজো ভাই দশম শ্রেণির ছাত্র মোঃ আসাদুল ইসলাম ফাতেমী মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর কর্মচারী হিসেবে বুড়িমারী ও নাগেশ্বরী মুক্তাঞ্চলে কর্মরত ছিলেন।
নির্মম নির্যাতনের কারণে তখনো অসুস্থ থাকায় আব্বা রাজশাহীতে তার শ্যালকের বাসায় চিকিৎসাধীন ছিলেন প্রায় তিন মাস। ডিসেম্বরের প্রথম দিকে তিনি বাড়িতে ফিরে গিয়ে ১৪ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের ‘সি’ ক্যাম্প চন্দনপাট থেকে আমাদের বাড়িতে স্থানান্তর করেন। তখন তাজির আলী, ইমান আলী ও গোলাম মোস্তফাসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা সেই ক্যাম্পে অবস্থান নেন। ১৬ ডিসেম্বর আমার ভাইসহ তারা রংপুর মেডিক্যাল কলেজে রংপুর পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে মুক্তিযোদ্ধাদের হেডকোয়ার্টারে গিয়ে নিজেদের অস্ত্রগুলো জমা দেন।
বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। তাই যেকোনো বিষয়ে নিজের মতো করে মত প্রকাশ এবং দলীয় মতাদর্শ প্রকাশের স্বাধীনতা সবার আছে। মনে রাখতে হবে, হাতের পাঁচ আঙ্গুল মোটেই সমান নয়। পরিবার বড় হোক কিংবা ছোট হোক – সেই পরিবারের সব সদস্য একই চরিত্রের বা মতাদর্শের নাও হতে পারে। আত্মীয়তার সূত্রে হলেও সেই পরিবারে অন্য ভাবাদর্শ বা মতাদর্শের মানুষ ঢুকে পড়তে পারে। বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত এমন অনেক প্রমাণের কথা আমাদের সবার জানা।
আমি মনে করি, কিছু ব্যক্তি তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে লালমনিরহাটের রাজনৈতিক অঙ্গনের সম্মানিত অভিভাবকদের বিপথগামী করার চেষ্টা করছেন। ৯ ভাইয়ের কোনো এক ভাইয়ের শ্বশুর আমার পরিবারের কেউ নয়। প্রতিটি মানুষকে তার নিজের কৃতকর্মের দায় নিজেকেই নিতে হয়। সেই দায় কখনোই অন্য কারও হতে পারে না। লালমনিরহাটের শিক্ষা, সাংস্কৃতিক অঙ্গন ও খেলাধুলার বিকাশে আমার পরিবারের প্রতিটি সদস্যই কাজ করে যাচ্ছেন, যা সবাই জানেন।
আমার এই লেখনীর উদ্দেশ্য প্রকৃত সত্য তুলে ধরা, কাউকে আঘাত দেয়া নয়। আমার উদ্দেশ্য, বিভেদের দেয়াল ভেঙ্গে দিয়ে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করা। আমার বিশ্বাস, প্রতিটি মন্দ শেষে ভালো আসবেই। অন্ধকার শেষে আলো আসবেই।